-অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন
বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাচীনতম জনপদের নাম কাপাসিয়া। এ দেশের প্রাচীন ভূখন্ডগুলোর অন্তর্ভুক্ত কাপাসিয়ার সমগ্র অঞ্চল। এ অঞ্চলের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। মুসলিমপূর্ব যুগ হতে সমগ্র মুসলিম শাসন আমলে উত্তরে টোক থেকে শুরু করে পূর্বে কিশোরগঞ্জ ও দক্ষিণে সোনারগাঁও পর্যন্ত এলাকা জুড়ে উৎপাদিত হতো ইতিহাস বিখ্যাত কিংবদন্তির মসলিন কাপড়। সেই অতি সু² মসলিন বস্ত্রের জন্য মিহি আঁশের কার্পাস তুলা উৎপাদিত হতো শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে। সংস্কৃত ও হিব্রæ ভাষায় তুলার অপর নাম কার্পাস। পার্সী ভাষায় কারবস, বাংলা ও হিন্দী ভাষায় কাপাস। কাপাসের গাছকে বলা হয় কাপাসি। এই কার্পাস শব্দ হতে কাপাসিয়ার নামকরণ করা হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষকগণ মনে করেন। খ্রিষ্টপূর্ব যুগ হতে এ অঞ্চলে কার্পাস তুলার ব্যাপক চাষাবাদ ছিল। কাপাসিয়া ছিল মসলিন উৎপাদন ও বিক্রয়ের জন্য একটি বৃহৎবাণিজ্য কেন্দ্র। কার্পাস ও রেশমী বস্ত্র প্রাচীন বাংলার অর্থনীতিকে করেছিলো শক্তিশালী। কাপাসিয়ার ভূমি ও আবহাওয়া তুলা উৎপন্ন হওয়ার বেশ উপযোগী ছিল। পর্যাপ্ত পরিমানে কার্পাস তুলা উৎপন্ন হওয়ায় এই স্থানের নাম কাপাসিয়া হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। মসলিন কাপড় পৃথিবীর সর্বত্র সমাদৃত ছিল। সে মসলিনের জন্য বঙ্গদেশের সুলতানদের বেগমরা যেমন লালায়িত ছিলেন তেমনি দিল্লীর মুগল স¤্রাটদের বেগমরাও ব্যাকুল ছিলেন। এটা তাদের প্রিয় বস্ত্র ছিল। এ বস্ত্র ছিল সৌন্দর্য্যরে অহংকার।
খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রীক ভৌগোলিক দিউ গোরাস কাপাসিয়া অঞ্চলের সূতীবস্ত্র ও তার রংয়ের উপকরণ সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য লিখেছেন তাঁর রচিত গ্রন্থে। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে এ গৌরবময় মসলিন শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ন ধ্বংস করা হয়।
দেশ-বিদেশে এ অঞ্চলের কার্পাস বস্ত্রের বিপুল চাহিদা এখানকার উন্নত প্রযুক্তি ও বিকাশমান সভ্যতার পরিচয় বহন করে। কাপাসিয়া অঞ্চলের সাথে খৃষ্টপূর্ব কালেই শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। নদী তীরবর্তী নৌবন্দরগুলোর সাথে পূর্ব দিকে প্রাচীন সমতটের রাজধানী রোহিতাগীরি(ময়নামতি), উত্তরে প্রাচীন পুন্ড্রনগর(বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়), দক্ষিন-পশ্চিমে তাম্রলিপি(হুগলী) এবং দক্ষিণে প্রাচীন সামুদ্রিক বন্দরের সংগে একটি আন্তঃ বাণিজ্য ব্যবস্থা ও যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। আর এ বাণিজ্য ব্যবস্থা ক্রমাš^য়ে সম্প্রসারিত হয়েছিল গ্রীক প্রাশ্চাত্যের দেশ সমূহে। নৌপথে সুদূর আরবের সাথে কাপাসিয়ার বাণিজ্যিক সমর্ক ছিল বলে জানা যায়।
কাপাসিয়া বাংলাদেশের প্রাচীন এলাকা সমূহের মধ্যে একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এলাকা, যার রয়েছে সুদীর্ঘ প্রাচীন ইতিহাস। ধারণা করা যায় যে, কাপাসিয়ার জন্ম প্রায় ২০০০ বছর আগে।
কাপাসিয়া অঞ্চল ঐতিহাসিককালে কখনো সমৃদ্ধ জনপদ, কখনো গভীর অরণ্য, কখনো নদী গর্ভে বিলীন, আবার কখনো নতুন নতুন ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। কাপাসিয়ার লোকবসতি কোন একক এলাকা বা কোন বিশেষ গোষ্ঠী থেকে সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে পড়েনি।পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছেন।কাপাসিয়া উপজেলার ভূমি গঠন, জনবসতি, প্রাকৃতিক কারণে পরিবর্তিত হয়েছে।এছাড়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ভৌগোলিক সীমা রেখা ও বার বার পরিবর্তন হয়েছে।
কাপাসিয়া অঞ্চল সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ও বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী ছিলো। খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মিশরীয় জ্যোতির্বিদ ও ভৌগোলিক টলেমির গ্রন্থে ব্রহ্মপূত্রের তীরে অবস্থিত তোগমা, হাতিবন্ধ, এন্টিভাল, কার্পাস ইত্যাদি নামের উল্লেখ রয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ কাপাসিয়াকে কার্পাসি, টোককে তোগমা এবং হাতিবন্ধকে হাতিবান্ধা রূপে সনাক্ত করেছেন। ঐতিহাসিকগণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, টোক নামক স্থানে ‘তাগমা’ শহর অবস্থিত ছিল। ‘তাগমা’ শহরকে ‘তাউফ’ এবং নবম শতাব্দীর মুসলিম পরিব্রাজকগন (পর্যটকগন) ‘তাফেক’ নামে উল্লেখ করেছেন।
উনবিংশ শতাব্দীর ত্রিশ দশকে ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর ‘টপোগ্রাফী অব ঢাকা’-গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- শীতলক্ষ্যা ও বানার নদীর সংযোগ স্থলে ‘এন্টিবোল’ শহর অবস্থিত ছিল। অনেক গবেষকগণ ‘তাগমাকে’ ‘এন্টিবোল’ এর সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন।
গুপ্ত স¤্রাটের অনৈক্যের সুযোগে ৫০৭-৮ খ্রীষ্টাব্দের কিছু পরে বৈন্যগুপ্ত বঙ্গে ¯^াধীনতা ঘোষণা করেন। তার রাজধানী ছিল শ্রীপুর। এই শ্রীপুর একদিন কাপাসিয়ার অধীন ছিল। বৈন্যগুপ্তের অনেক পরে বানিয়া রাজা শিশুপাল শ্রীপুর দিবলী ছিট এলাকায় রাজধানী স্থাপন করে রাজত্ব করতেন। তিনি বাংলার পাল রাজাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন। শ্রীপুর উপজেলার কর্নপুরে এবং কাপাসিয়া উপজেলার বাড়ির চালায় (বর্তমানে বারিষাব ইউনিয়নের গিয়াসপুর) এখনো সেই আমলের বিরাট দিঘী রয়েছে। টোক বা তাগমা সে সময়ে ছিল জমজমাট বন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র।বানিয়া রাজারা এই এলাকায় প্রায় ৪ শত বছর রাজত্ব করেছিলেন।
কাপাসিয়া উপজেলার উত্তরে কপালেশ্বর নামক একটি সু-প্রাচীন গ্রাম রয়েছে।এখানে রাজা শিশুপালের রাজধানী ছিল বলে জানা যায়। গ্রামের মাঝখানে একটি শান বাঁধানো বিরাট দিঘী রয়েছে। কপালেশ্বরের অনতিদূরে দরদরিয়া গ্রামে শাহারবিদ্যা কোট শিশুপালের দূর্গ ছিল বলে জানা যায়। সে দূর্গের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। শিশুপালের অন্তর রানী ভবানী এ দূর্গে অবস্থান করতেন। এখনো একটি ভিটি ‘রাণী বাড়ী” নামে পরিচিত।
একাদশ শতাব্দীর রাম রচিত তা¤্রলিপি থেকে জানা যায় যে, রাজা কর্ণের মেয়ে যৌবন শ্রীকে রাজা বিগ্রহপালের নিকট বিবাহ দেন। কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী গ্রামের নাম করনের সাথে রাজা কর্ণের পরিবারের যৌবনশ্রীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে বলে অনেকের ধারনা।
বারিষাব ইউনিয়নের ভেড়ার চালা এলাকায় বঙ্গে বরগীদের আস্তানা ছিল বলে লোকমুখে শোনা যায়।
১২৬৮ সালে দিল্লীর সুলতান বলবল, তুঘ্রিল বেগকে ঢাকার শাসক হিসেবে পাঠালে তিনি বৃহত্তর জেলাতে কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা করে স্থানীয় হিন্দু রাজা দনুজ রায়কে ১২৭৫ সালে পরাজিত করেন। ফলে কাপাসিয়া সহ বৃহত্তর ঢাকায় মুসলিম শাসন স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর কখনো গৌড় হতে, কখনো সোনারগাঁও হতে শান্তিপূর্ন ভাবে কাপাসিয়া অঞ্চল শাসিত হতে থাকে।
কাপাসিয়ার দূর্গাপুর ইউনিয়নের তারাগঞ্জ এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে ইতিহাস বিখ্যাত একডালা দূর্গ ছিল বলে জানা যায়। দুর্গটি দৈর্ঘ্যে ৫ মাইল এবং প্রস্থে ২ মাইল পর্যন্ত পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। জেমস্ টেইলর এর বিবরণ থেকে পাওয়া যায়, একডালা দুর্গটি অর্ধচন্দ্রাকারে নদীর পাশে নির্মান করা হয়েছিল। কাদা মাটির সংমিশ্রিতি লাল মাটি দ্বারা এর বাইরের দেয়াল গঠিত এবং এ দেয়ালের উচ্চতা ছিল ১২/১৩ ফুট। দুর্গের ভিতরে প্রবেশের জন্য ছিল ৫টি তোরণ। দূর্গটি ‘রানী বাড়ী’ নামেও পরিচিত ছিল। যা রানী ভবানীর সম্পত্তি বলে লোকমুখে কথিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে রানী ভবানী বানিয়া রাজাদের শেষ বংশধর ছিলেন। তিনি ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে এ দেশে মুসলিম অভিযানের সময় এ দূর্গে বসবাস করেছিলেন।
স্টুয়ার্টকৃত হিস্টোরি অব বেঙ্গল এবং জেমস টেলরের মতে এটাই বিখ্যাত একডালা দুর্গ। এ দুর্গে বাংলার ¯^াধীন সুলতান শামসু্িদ্দন ইলিয়াস শাহ্ ১৩৫৩ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়েছিলেন।দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক, বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য পর পর দুই বার এ দূর্গে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। শত চেষ্টা করেও সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক একডালা দুর্গ দখল করতে পারেননি। এক সময় ফিরোজ শাহ অবরোধ তুলে দিল্লী ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। দূর্গাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পার্শ্বে একডালা নামে একটি গ্রাম রয়েছে যা একডালা দুর্গের স্মৃতি বহন করে। তারাগঞ্জ বাজারের দক্ষিণে বাংলার টেক এবং রাণীগঞ্জ বাজারের উত্তরে থানার টেক ও লোহার টেক একডালা দূর্গের অন্তর্ভূক্ত ছিল।বাংলার টেকের মাটি খুড়ে বৃহৎআকারের ইট পাথরের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে বলে ওই এলাকার প্রবীণরা জানায়। তবে একডালার দূর্গ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
চতুর্দশ শতকের প্রথমভাগে বার ভূইয়াদের অন্যতম শাসক ফজল গাজীর নিয়ন্ত্রনে আসে কাপাসিয়া সহ সমগ্র ভাওয়াল অঞ্চল। কাপাসিয়া এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অগনিত মোগল পাঠান যুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থান।
কাপাসিয়ার উত্তরাঞ্চল টোক নগরের বহ্মপুত্র নদীর বিপরীতে ঐতিহাসিক ‘এগারসিন্ধু’ অবস্থিত। ১৫৭৬-৭৭ খ্রীষ্টাব্দ মোঘল স¤্রাট আকবরের নৌ-সেনাপতি খান জাহান, বার ভূঁইয়াদের বিখ্যাত নেতা ঈশাখাঁকে আক্রমন করলে ঈসা খাঁ তার মিত্রদের নিয়ে মোগল নৌবহরের উপর পাল্টা আক্রমন করে পর্যুদস্ত করেন।
১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে শাহবাজখান মোগল সেনাপতি নিযুক্ত হয়ে ‘এগারসিন্ধু’ দখল করে টোক নামক স্থানে নৌ-ঘাটি স্থাপন করেন। বর্ষাকাল আসলে একদিন অন্ধকার রাতে ঈসা খাঁ পাশের জায়গায় ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে নৌবহর ভাসিয়ে দেন। ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে আকবর মানসিংহকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করে পাঠালে তিনি ১৫৯৭ খ্রীষ্টাব্দে ঈসাখাঁর সঙ্গে নৌ সংঘর্ষে লিপ্ত হন। যুদ্ধে মানসিংহের তলোয়ার ভেঙ্গে গেলে ঈসাখাঁ উদারতা প্রদর্শন করে তার হাতের অপর তলোয়ারটি প্রদান করেন। এঘটনায় মানসিংহ পরাজয় ¯^ীকার করে ঈসা খাঁকে বুকে জড়িয়ে নেন। ফলশ্রæতিতে স¤্রাট আকবর ঈসা খাঁকে কাপাসিয়া অঞ্চলসহ বাইশ পরগনার জমিদারি প্রদান করেন। পরবর্তীতে মোগল সুবেদার ইসলাম খান বার ভূঁইয়াদের কঠোরভাবে দমন করলে কাপাসিয়াসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার ইসলাম খান মুর্শিদাবাদের রাজমহল হতে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে কাপাসিয়ার দ্বার-ই-দরিয়া আসেন।স্থানটি উচু-নীচু বলে তিনি রাজধানী স্থাপন না করে চলে গিয়ে ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন।
টোক শহরের পূর্বদিকে সুলতানপুর গ্রামে একটি শাহী মসজিদ আছে। টোক শহরের নদীর ওপারে (উত্তরে) এগারসিন্ধুরে সুলতানপুরের শাহী মসজিদের অবিকল ৩টি প্রাচীন মসজিদ ছিল। বর্তমানে দুটি মসজিদ অক্ষত থাকলেও একটি মসজিদ ব্রহ্মপুত্র নদে তলিয়ে গেছে বলে জানা যায়। টোক শহরের পশ্চিম দক্ষিণে কপালেশ্বর গ্রামে পাশাপাশি কয়েকটি বড় দিঘী আছে। কপালেশ্বরের দিঘীর পাড় দিয়ে একটি ইটের সড়ক টোক শহর পর্যন্ত গিয়েছে বলে লোকমুখে জানা যায়। কপালেশ্বর বাজারের বড় দিঘীর উত্তর পার থেকে পূর্বে ও উত্তরে মাটির নীচে গর্ত খুঁড়লে ইটের রাস্তা পাওয়া যাবে বলে অনেকের ধারনা।
প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ কাপাসিয়া খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। মুগল আমলে স¤্রাট আকবরের সময় প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরীতে’ উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘ঢাকার অদূরে কাপাসিয়া অঞ্চলে লোহা পাওয়া যেত। যার লোহা দিয়ে কামার গাঁওয়ের কামারগন অস্ত্র তৈরি করে বার ভূইয়াদের নেতা ঈসা খাঁকে সরবরাহ করত। মীর জুমলার আমলের কামানগুলো লোহাদী গ্রামের খনি থেকে উত্তোলিত লোহা দিয়ে তৈরী বলে জানা যায়। প্রখ্যাত ইংরেজ চিকিৎসক ও ঢাকার সিভিল সার্জন (১৮৬০) জেমস ওয়াইজের মতে, কাপাসিয়ার উত্তরাঞ্চল লৌহ সম্পদে সমৃদ্ধ। লোহাদী গ্রামের লোহার যে স্তরটি মাটির উপর বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে তা আকরিক লোহার উজ্জল নির্দশন। মাটির উপরে ও নীচে রয়েছে এক প্রকার আয়রন হুড। জাতীয় যাদুঘরের মহাপরিচালক ডঃ এনামুল হক ও জনৈক বিশিষ্ট প্রতœতত্ত¡বিদ ১৯৭৮ সালে কাপাসিয়ার উত্তরাঞ্চলে সফরে আসেন।তিনি অসংখ্য পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ কপালেশ্বর নামক প্রাচীন গ্রাম পরিদর্শন করেন। তার মতে রাজা শিশুপালের রাজধানী ছিল এখানে এবং গ্রামের মধ্যখানে অবস্থিত শান বাঁধানো বিরাট অট্রালিকায় বাস করতেন। পার্শ্ববর্তী দরদরিয়াতে শিশুপালের দূর্গ ছিল, যাতে রানী ভবানী বাস করতেন।” একই সময়ের তারাগঞ্জ এর একডালার দূর্গও ইতিহাস সমৃদ্ধ।
১৮৫৮ সালে ভারতবর্ষে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্ব শেষ হয় এবং মহারানী ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৮৬১ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নির্দেশে বেঙ্গল পুলিশ এ্যাক্ট প্রবর্তন করা হয়। ঐ বৎসরই কতগুলি পুলিশের থানা সৃষ্টি করা হয় কোতুয়ালী থানা নামে। পরবর্তীতে ১৮৬৫ সালে কাপাসিয়া-গফরগাঁও থানার মধ্যে কংশ নামে একটি পুলিশের থানা স্থাপন করা হয়েছিল এবং এটা ৫ বছর চালু থাকার পর বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৮৮০ সালে কাপাসিয়া থানা স্থাপন করা হয় এবং শ্রীপুর তার অন্তর্ভুক্ত থাকে। ১৯১৪ সালে প্রথমে শ্রীপুরে একটি ছোট পুলিশ ইনভেস্টিগেশন সেন্টার খোলা হয়। তৎপরবর্তী পর্যায়ে ১৯৩৩ সালে ৭ই অক্টোবর শ্রীপুরকে পূর্নাঙ্গ থানা হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ১৯১০ সালের দিকে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে কাপাসিয়াকে কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ ও শ্রীপুর- এ তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়।
কাপাসিয়া থানায় বৃটিশ রাজত্বের সময় ২৮টি ইউনিয়ন ছিল বলে জানা যায়।ইউনিয়নগুলি হলো-সিংশ্রী, টোক, বারিষাব, ঘাগটিয়া, সনমানিয়া, তরগাঁও, কড়িহাতা, কাপাসিয়া, দূর্গাপুর, চাঁদপুর, চরসিন্দুর, গজারিয়া, ঘোড়াশাল, জিনারদী, জামালপুর, কালীগঞ্জ, জাঙ্গালিয়া, মোক্তারপুর, বক্তারপুর, বাড়িয়া, প্রহলাদপুর, রাজাবাড়ী, গোসিংগা, বরমী, কাওরাইদ, শ্রীপুর, মাওনা, গাজীপুর।
১৯২৪ সালে বৃটিশ সরকার শাসনকার্যের সুবিধার্থে কাপাসিয়া থানাকে ভেঙ্গে তিন থানায় বিভক্ত করেন। ১নং হতে ১০নং পর্যন্ত ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করেন কাপাসিয়া থানা, ১১ নং হতে ২০নং ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করেন কালীগঞ্জ থানা এবং ২১নং হতে ২৮ নং পর্যন্ত ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করা হয় শ্রীপুর থানা। শাসন কার্যের সুবিধার্থে ১৯৫৯ সনে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার কাপাসিয়া থানার সিংহশ্রী ইউনয়নকে বিভক্ত করে সিংহশ্রী ও রায়েদ ইউনিয়নে রূপান্তরিত করা হয়। এক সময় গাজীপুর মহকুমার অন্তর্ভূক্ত কাপাসিয়া থানাকে ১৫-১২-১৯৮২ সালে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। কাপাসিয়া উপজেলার বর্তমান আয়তন ৩৫৬.৯৮ বর্গকিলোমিটার। কাপাসিয়া উপজেলা প্রায় ২৩০৫র্৫ ও ২৪০১র্২ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৯০০২র্৯ ও ৯০০৪র্৩ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত।
লেখকঃ
অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তারাগঞ্জ কলেজ
সাধারণ সম্পাদক, কাপাসিয়া প্রেস ক্লাব
উপ-মহাদেশের প্রাচীণতম ঐতিহাসিক অঞ্চল কাপাসিয়া
ভাওয়ালের গাজী বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ফজল গাজী ও বাহাদুর গাজীর স্মৃতি বিজরিত আজকের গাজীপুর জেলার অন্যতম উপজেলা কাপাসিয়া। প্রায় ৪ লাখ মানুষের বসতি কাপাসিয়া উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন। শীতলক্ষ্যা, বানার, ব্রম্মপুত্র নদের বিধৌত কাপাসিয়ার জন্ম প্রায় আড়াই হাজার বছর পুর্বে।
কাপাসিয়ার ইতিহাস গবেষণায় লিপ্ত মোহাম্মদ আসাদ সাহেবের ’কাপাসিয়ার ইতিহাস’ নামক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, কাপাসিয়া অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাচীণতম ঐতিহাসিক স্থান।কার্পাস (তুলা) থেকে কাপাসিয়ান এবং কাপাসিয়ান নামানুসারে কালক্রমে কাপাসিয়া নামের উৎপত্তি। খৃষ্টপুর্ব যুগে এ অঞ্চলে কার্পাস তুলার ব্যাপক চাষাবাদ ছিল এবং অতি উৎকৃষ্ট মসলিন বস্ত্রাদি বয়ণ করা হতো। গ্রীক-ল্যাটিন-আরব, চীন, ইটালীয় পর্যটক ব্যবসায়ীদের বিবরণ থেকে জানা যায় প্রাচীণ বাংলার অতি সুক্ষ্ণ কার্পাস ও অপুর্ব রেশমী বস্ত্র এদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছিলো। কার্পাসিয়া ছিল সম্পূর্ণ প্রস্ত্তত এক প্রকারের কাপড়। এটা এত চিকন ছিল যে, রোম সাম্রাজ্যের অভিজাতরা এ বস্ত্র ক্রয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। বিশিষ্ট দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহেব কাপাসিয়ার প্রথম ও একমাত্র পত্রিকা ’’সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা’’র প্রকাশনা উৎসব সংখ্যায় শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, কার্পাস থেকেই জগত বিখ্যাত মসলিন কাপড় তৈরী হতো। সে মসলিনের জন্য বঙ্গদেশের সুলতানদের বেগমেরা যেমন লালায়িত ছিলেন তেমনি দিল্লীর মুগল সম্রাটদের বেগমেরাও ব্যাকুলতা ছিলেন। ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের পরে এসব বস্ত্রের প্রস্ত্ততকারকদের বাধ্য করে এ সুক্ষ্ণ বস্ত্র তৈরী করতে বিরত করা হয়। সে ভীষণ শত্রুতার কাজ কোম্পানীর আমলের কোন নৃশংস শাসকের আদেশে হয়েছিলো তার নাম এখন উদ্ধার করা দরকার। কাজেই কাপাসিয়ার অতীত ইতিহাস সমন্ধে গবেষণা করার এখনো প্রচুর বিষয়বস্ত্ত রয়েছে। কাপাসিয়া নামটি খৃষ্টীয় প্রথম শতকে ইউরোপীয় লেখক বিপ্লবীর উল্লেখিত কাপাসিয়ান বা কাপাসিয়াম শব্দের স্মৃতি বহন করে চলছে।
১৯১০ সালের পরে প্রশাসনিক কারণে কাপাসিয়াকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়; কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ ও শ্রীপুর। পুর্বে শ্রীপুর ও কালীগঞ্জ উপজেলা কাপাসিয়ার অন্তর্ভূক্ত ছিল।
কাপাসিয়া অঞ্চল খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর পুর্বেই সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী ছিল। খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মিশরীয় জ্যোতির্বিদ টলেমীর বিবরণে কাপাসিয়ার ’তাগমা’ ও এ্যান্টিবোল শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকগণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, টোক নামক স্থানে বানার নদের পুর্ব তীরে ’তাগমা শহর অবস্থিত ছিল। ’তাগমা’ শহরকে ’তাউফ’ এবং নবম শতাব্দীর মুসলিম পরিব্রাজকগণ ’তাফেক’ নামে উল্লেখ করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর লোকেরা বিশ্বাস করতো এখানে মাটির নীচে মূল্যবান ধন সম্পদ রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর ত্রিশ দশকে ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর সাহেব ’টেপোগ্রাফী অব ঢাকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ’শীতলক্ষ্যা ও বানার নদীর সংযোগস্থানে এ্যান্টিবোল শহর অবস্থিত। ইউলফোর্ড তাগমাকে এ্যান্টিবোল এর সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। শীতলক্ষ্যা ও বানার নদের সংযোগস্থল হচ্ছে বর্তমান লাখপুর ও রাণীগঞ্জ বাজারের কাছে। এখানে পুরাতন ব্রম্মপুত্র নদ শীতলক্ষ্যা’র সাথে মিলিত হয়েছে। এখানেই প্রতিবছর (পুরাতন ব্রম্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে) ব্রম্মপুত্র নদে হিন্দুরা অষ্টমীর স্নান করে ও বটতলায় মেলা বসে। এ মেলা ’ঘিঘাট অষ্টমীর’ মেলা নামে পরিচিত।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কাপাসিয়া মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুরের সমসাময়িক। সোনারগাঁও, বিক্রমপুর, সাভার ও ময়নামতির চাইতেও প্রাচীণ। এমনও হতে পারে খৃষ্টপুর্ব যুগের সভ্যতা ধীর প্রবাহিনী ব্রম্মপুত্রনদের পলি বিধৌত মাটির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে।
গুপ্ত সম্রাটের অনৈক্যের সুযোগে ৫০৭-৮ খৃষ্টাব্দের কিছু পরে বৈন্যগুপ্ত বঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার রাজধানী ছিলো শ্রীপুর। ঐতিহাসিকগণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ইহা বর্তমান গাজীপুর জেলার শ্রীপুর বা এক সময় কাপাসিয়ার অন্তর্ভূক্ত ছিল। বৈন্যগুপ্তের অনেক পরে বাণিয়া রাজা শিশুপাল শ্রীপুর দীঘলিছিট এলাকায় রাজধানী স্থাপন করে রাজত্ব করতেন। তিনি বাংলার পাল রাজাদের পুর্ব পুরুষ ছিলেন। শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগার পশ্চিম পার্শ্বে কর্ণপুরে এবং কাপাসিয়া উপজেলার ভেরারচালায় (শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিনের নামানুসারে বর্তমানে গিয়াসপুর) এখনো সেই আমলের বিরাট দিঘী রয়েছে।
টোক শহর বা তাগমা সে সময়ে নি:সন্দেহে ব্রম্মপুত্র ও বানার নদের সংযোগস্থলে সুবিধাজনক অবস্থানের জন্য একটি জমজমাট বন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র ছিল। বানিয়া রাজারা এই এলাকায় প্রায় চারশত বছর রাজত্ব করেন। তাদের সর্বাধিক প্রাচীণ পুরা কীর্তির স্থানগুলো বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমানের দরদরিয়া নামে পরিচিত বানার নদের তীরে প্রাচীণ একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এর বিপরীত দিকে একটি শহরের ভিত্তিভূমি পরিলক্ষিত হয়। উভয় শহরই বানিয়া রাজাদের দ্বারা স্থাপিত হয় এবং তাদের দখলে ছিল।
কাপাসিয়া উপজেলাধীন দুর্গাপুর ইউনিয়নে একডালা দুর্গ বিদ্যমান ছিল। এ দুর্গটি হিন্দু যুগে অনুমান ৬শত খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অনুমেয়। কাপাসিয়া সদর হতে প্রায় ৫ কি.মি দক্ষিণ-পুর্বে বানার নদের পুর্ব পারে দুর্গাপুর ইউনিয়নের চাঁপাত, সোনারখিল, বড়চালা, নাজাই, রাওনাটের পুর্বাংশ, চাটারবাগ, দেইলগাঁও, ঘিগাট ও একডালা মৌজাসমূহ এই দুর্গের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই দুর্গের অন্তর্ভূক্ত একটি জায়গাকে আজও থানারটেক ও অন্য একটি জায়গাকে লোহাড়টেক বলে থাকে। জেমস টেলর সাহেবের বিবরণ থেকে জানা যায়, দুর্গটি বাহ্যত: অর্ধ চন্দ্রাকারে নদীর পার্শ্বে নির্মিত হয়েছিল। কাঁদা মাটির সংমিশ্রিত লাল মৃত্তিকা দ্বারা এর বহির্দেয়াল গঠিত এবং এর উচ্চতা ১২ কি ১৪ ফুটের অধিক ছিল না। এর বেষ্টিত স্থানের পরিমাণ দৈর্ঘ প্রায় ৬ কি.মি. এবং প্রস্থে ৩ কি.মি. এবং প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ত পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য পাঁচটি তোরণদ্বার ছিল। দুর্গটি ’রাণী বাড়ী’ নামে পরিচিত ছিল। যা রাণী ভবানীর সম্পত্তি বলে কথিত। ইনিই খুব সম্ভবত: বানিয়া রাজাদের শেষ বংশধর ছিলেন যিনি ১২০৪ খৃষ্টাব্দে এদেশে মুসলিম অভিযানের সময় উক্ত দুর্গে বসবাস করছিলেন। এ দুর্গটি বেশ মজবুত ছিল। ষ্টুয়ার্টকৃত হিষ্টোরী অব বেঙ্গল এবং জেমস টেলরের মতে এটাই বিখ্যাত একডালা দুর্গ। কথিত আছে এই দুর্গ হতে পুর্ব দিকে শিবপুর উপজেলার পাড় জয়নগর পর্যন্ত অনুমান ১৬ কি.মি. দুর পর্যন্ত খেয়া নৌকায় লোক পারাপার করতো। এ দুর্গের অন্তর্ভূক্ত নাজাই মৌজার চৌকিদার বাড়ীর পশ্চিম পাশে গুপ্ত কোষাগার ছিল বলে অনেকে মনে করতো। এ দুর্গের বাংলার দ্বিতীয় স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) ১৩৫৩ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়েছিলেন। উল্লেখ আছে যে, অবরোধ চলাকালীন সময়ে ইলিয়াস শাহ ফকিরের ছদ্মবেশে রাজা বিয়াবানী নামে পরিচিত একজন প্রসিদ্ধ সাধু দরবেশের জানাযায় যোগদানের উদ্দেশ্যে দুর্গ থেকে বের হয়ে পড়েন। পরিচয় গোপন থাকায় তিনি অক্ষত অবস্থায় দুর্গে প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হন। রাজা বিয়াবানী খুব সম্ভবত: রাণী ভবানীর একজন বংশধর ছিলেন। শতচেষ্টা করেও সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক একডালা দুর্গ দখল করতে পারেননি। অবশেষে ফিরোজ শাহ অবরোধ তুলে দিল্লী ফিরে যান।
বার ভূইয়াদের দমন করে এদেশে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সম্রাট আকবর ১৫৮৩ খৃষ্টাব্দে তাঁর অন্যতম খ্যাতনামা সেনাপতি শাহবাজ খানকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করেন। শাহবাজ খান বার ভূইয়াদের নেতা ঈশা খাঁ ও মাসুম খাঁ কাবুলীর বিরম্নদ্ধে ব্যাপক অভিযানের আয়োজন করেন। এ সময় ঈশা খাঁ কুচবিহারের শাসকদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে মোগল সেনাপতি সোনারগাঁও, কাত্রাবু ও এগারসিন্দুর দখল করে ব্রম্মপুত্র নদের পশ্চিম-দক্ষিণ তীরে টোক নামক স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেন। ঈশা খাঁ ও মাসুম খাঁ কাবুলী কুচহিার থেকে ফিরে এসে মোগল সৈন্যদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। উভয় পক্ষে প্রায় প্রতিদিনই ছোট-খাট যুদ্ধ হতে থাকে। শাহবাজ খান তরসুন খানের নেতৃত্বে একটি সেনাদল বাজিতপুরের দিকে পাঠালে ঈশা খাঁ তাকে পরাজিত, বন্ধী ও পরে হত্যা করেন। শাহবাজ খান ৭ মাস ধরে টোকে অবস্থান করেন। তিনি মাসুম খাঁ কাবুলীকে তাঁর হস্তে সমপর্ণের দাবি জানান। ঈশা খাঁ নানা অজুহাতে সময় কাটাতে থাকেন। ইতোমেধ্য শাহবাজ খানের কড়া মেজাজের ধরুন তার সৈন্যদলে ভাঙ্গন শুরম্ন হয়। অপরদিকে বর্ষার ফলে এদেশ ডুবে যায়। ঈশা খাঁ স্বয়ং ভাসমান মোগল শিবির আক্রমন করেন। শাহবাজ খান কোন প্রকারে আক্রমন প্রতিহত করে ভাওয়ালের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিতে সমর্থন হন। ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দের ৩০শে সেপ্টেম্বর ভাওয়ালে শাহবাজ খান সকল বিজিত স্থান ছেড়ে দিয়ে তান্ডায় প্রত্যাবর্তন করেন।
এখনো টোক শহরে আদিকালের অনেক ধ্বংসস্ত্তপ দেখা যায়। টোক শহরের একটু পুর্বে সুলতানপুর গ্রামে শাহী মসজিদ আছে। টোক শহরের একটু পশ্চিম-দক্ষিণে কপালেশ্বর গ্রামে পাশাপাশি কয়েকটি বড় বড় দিঘী আছে। কপালেশ্বর বাজারের বড় দিঘীর উত্তর পার থেকে পুর্বে ও উত্তরে ৩/৪ হাত মাটির নীচে খুড়লে ইটের রাস্তা পাওয়া যায়। এসব ইট তুলে এলাকার লোকেরা দালানের কাজে ব্যবহার করতে দেখা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এ দিঘীর উত্তর পার দিয়েই একটি ইটের সড়ক টোক শহর পর্যন্ত গিয়েছে। অনেকে মনে করেন যে, টোক শহর নদীর তীরে হওয়ায় নদীর তীর থেকে একটু দুরে সুবধাজনক স্থানে ইমারত তৈরী করেছিলেন। কপালেশ্বর সমন্ধে কোন ঐতিহাসিকগণ কিছু লিখে যাননি। টোক শহরের উত্তর পুর্বে ব্রম্মপুত্র নদের উত্তর পারেই এগারসিন্দুর অবস্থিত। সুলতানপুরের শাহী মসজিদের অবিকল আরও ৩টি মসজিদ ছিল। ৩টি মসজিদ সোজা উত্তর-দক্ষিণে সুবিধাজনক স্থানে নির্মিত হয়েছিল। এর একটি ব্রম্মপুত্র নদে তলিয়ে গেছে। অন্যটি ব্রম্মপুত্র নদের উত্তর পারে। টোক শহর কাপাসিয়া উপজেলার উত্তর সীমান্তে বানার ও ব্রম্মপুত্র নদের সংযোগস্থলের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। টোক শহর থেকে ২টি নদ দু’দিকে চলে গিয়ে পূণরায় লাখপুর ও রাণীগঞ্জ বাজারের কাছে শীতলক্ষ্যায় মিশে গেছে। ব্রম্মপুত্র নদ টোক থেকে পুর্বে মঠখোলা-আড়ালিয়ার কাছ দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে মনোহরদী উপজেলার পশ্চিম সীমানা ঘেষে কাপাসিয়া উপজেলার পুর্ব সীমানা ঘেষে হাতিরদিয়া বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে আড়াল বাজারের পুর্ব পাশ দিয়ে লাখপুর ও রাণীগঞ্জ বাজারের কাছে গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে মিশে গেছে। অপরদিকে বানার নদ টোক শহর হতে পশ্চিমে বরমী বাজারের পুর্ব পাশ দিয়ে গোসিংগা বাজারের পুর্ব পাশ দিয়ে দরদরিয়ার সাহাবদ্যার কোট ভবানীর দুর্গ এর পশ্চিম পাশ দিয়ে কাপাসিয়া বাজারের উত্তর পাশ দিয়ে লাখপুর ও রাণীগঞ্জ বাজারের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে মিশে গেছে। এ নদ ২টি কাপাসিয়া উপজেলার ৮টি ইউনিয়নকে ঘিরে প্রবাহিত হয়েছে। বানার নামক আরো ১টি নদের অবস্থান পাওয়া যায়। এ শাখা বানার নদটি টোক শহরের একটু পশ্চিমে উলুসারা জমিদারপঁচূ বাবুর বাড়ীর কাছ হতে বড় বানার নদ থেকে কাপাসিয়া উপজেলার মূল ভুখন্ডে ঢুকে। কথিত আছে, এ শাখা নদ দিয়ে ঈশাখাঁ নৌকা দিয়ে তার যুদ্ধের সৈন্যবাহিনী নিয়ে সোনারগাঁও যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। বন্যা বা বর্ষার পানি শাখা বানার নদ দিয়ে উপজেলার ভিতরে প্রবেশ করে ফসলাদি বিনষ্ট করতো, তাই উলুসারা গ্রামের নিকটবর্তী মূল নদরে কাছে বহুবছর পুর্বে শাখা বানারের মুখে বাঁধ দিয়ে শাখা বানার নদটির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ নদটি উলুসারা গ্রামের উপর দিয়ে দক্ষিণে কেন্দুয়াব, কপালেশ্বর ও নামিলা গ্রাম স্পর্স করে পুর্ব-দক্ষিণে উজুলী, লোহাদী গ্রামের উত্তর দিক দিয়ে সোজা পুর্ব দিকে চলে গেছে। বর্তমানে লোহাদী গ্রামের উত্তর পাশে যে পাত্তরদারা ব্রিজ দেখা যায় তা শাখা বানার নদের উপর নির্মিত। বানার নদ বারাব গ্রামের পুর্ব-উত্তর পাশ দিয়ে দিগাব গ্রামের নিকট দিয়ে দক্ষিণে বানারকান্দি গ্রাম হয়ে সোজা দক্ষিণে চালার বাজারের পুর্ব পাশ দিয়ে খিরাটী গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে কামারগাঁও গ্রামের পুর্ব পাশে বর্তমানে ঘোষাব নদী বা বিরাট জলাশয় (বিশ্রাম নিয়ে) হয়ে চিকন খালের মতো সনমানিয়া গ্রামের উপর দিয়ে পুরাতন ব্রম্মপুত্র নদের সাথে মিশে গেছে। ঘোরষাব জলাশয়টি বানার নদের অতীত চিহ্ন হিসেবে আজও বিদ্যমান। কথিত আছে এই জলাশয়ে এককালে ইলিশ পাওয়া যেতো। বর্তমানেও সেখানে বড় বড় নদীর মতো সকল প্রকার মাছ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে রম্নই, কাতলা, মৃগেল, কেচকি, চাপিলা, কই, সিং, তেলাপিয়া উল্লেখযোগ্য। এ শাখা বানার নদ দিয়ে তার যৌবনে শত শত পালতোলা নৌকা চলাচল করতো তার কোন ইয়াত্তা নেই। ময়মনসিংহ থেকে নৌপথে এ নদ দিয়ে দ্রুত রাণীগঞ্জ বাজারের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে যাওয়া যেত। কারণ টোক শহর থেকে নদী পথে রাণীগঞ্জ বাজারের দুরত্ব ৪০ কি.মি হলেও শাখা বানার নদ দিয়ে তা ছিলো মাত্র ১৪ কি.মি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় কালক্রমে শাখা বানার নদ ভরাট হয়ে তার তলদেশে মাটিচাপা পড়ে আছে কত না ইতিহাস-ঐতিহ্য। ১৯৭৬ সালে হারিয়ে যাওয়া বানার নদে বারাব বাজার মসজিদের কুপ খননকালে ২২ হাত মাটির নীচে একটি বড় নৌকার সন্ধান পাওয়া যায়। কাপাসিয়ার বারিষাব ইউনিয়নে লোহাদী নামে একটি গ্রাম আছে, লোহাড় খনি থেকে লৌহাদী নাম করণ করা হয়েছে। আবুল ফজলের ’আকবর নামায়’ উলেস্নখ আছে যে, এই লৌহাদী গ্রামের লোহ খনি থেকে বাদশাহী কামান তৈরী হতো। এখনো সেখানে লোহার চিত্র দেখা যায়। (সংকলিত) (৩ পৃষ্ঠায়লেখা)
সংগ্রহ: সাপ্তাহিক শীতলক্ষ্যা, কাপাসিয়া
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS